গাজায় হামলা, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে উত্তাল নাঃগঞ্জ

তৌকির আহমেদ :

প্রকাশ: ২৩:১৫, ৭ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ০০:৩১, ৯ এপ্রিল ২০২৫

গাজায় হামলা, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে উত্তাল নাঃগঞ্জ

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

মসজিদে আযান হচ্ছিল। আল্লাহু আকবর ধ্বনি উচ্চারণের সাথে সাথেই বিকট শব্দে উড়ে গেল সেই মসজিদ। চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল সেই হতভাগ্য ঈমাম। চিত্রটি গাজার। পিতা উবু হয়ে নিজের শিশুটির প্রাণ বাঁচালেন ইসরাইলের গানশীপের গুলি থেকে। পিতার পিঠ ঝাঝরা হয়ে গেছে। অবুঝ শিশুটি খেলা মনে করে হাসছিল। একটি শিশু দৌড়ে ভবনের ইটপাথরের জঞ্জালে আটকে পড়া আরেকটি শিশুর কাছে যাচ্ছিল। বুকে একটি গুলি লাগলো। লুটিয়ে পড়লো শিশুটি।

বাংলাদেশসহ সারাবিশে^র মানুষ এমন নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা সহ্য করতে পারছেনা। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে প্রাচ্যেরডান্ডি নারায়ণগঞ্জবাসী। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে উত্তাল ছিল নাঃগঞ্জ। সেই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে ধর্মপ্রাণ মুসল্লি, আমজনতা, প্রবীণ ব্যক্তি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ, বামদলের নেতৃবৃন্দ, তরুণ ও ছাত্রসমাজ লোকজন। সবাই গাজাকে ইসরাইলের নারকীয় বোমা হামলা থেকে বাঁচাতে চাইছেন।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল করছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতা। বিশ্বের সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করে সোমবার (৭ এপ্রিল) থেকে এ কর্মসূচি পালন করছে তারা। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ‘গাজা বাঁচাও’, ইসরায়েলের গণহত্যা বন্ধ কর’, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার চাই’—এমন নানা স্লোগান দিতে থাকেন।

ফিলিস্তিনের জনগণের উপর ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে চলমান 'ওয়ার্ল্ড স্ট্রাইক' কর্মসূচির সাথে সংহতি জানিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলা একটি সংহতি মিছিল আয়োজন করে। মিছিলটি নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে বঙ্গবন্ধু রোড প্রদক্ষিণ করে নিতাইগঞ্জ হয়ে পুনরায় নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।

মিছিল পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি ফারহানা মানিক মুনা বলেন, “বছরের পর বছর ফিলিস্তিনে বর্বরতা চলছে। সেখানে মায়ের কোল থেকে শিশুরা, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবক শহীদ হচ্ছে গোলাবারুদের বিস্ফোরণে। ইজরায়েল বিশ্বে বর্বরতার সমস্ত মাত্রা অতিক্রম করেছে। আর জাতিসংঘের মতো বিশ্ব মোড়ল বনে থাকা সংস্থাগুলো নিজেদের নিশ্চুপ অবস্থান নিয়ে গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। আমরা এই হত্যার নীতি থেকে পরিত্রাণ চাই। বিশ্ববাসী আজ যুদ্ধনীতির বিপরীতে ফিলিস্তিনের মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়ে 'ওয়ার্ল্ড স্ট্রাইক' পালন করছি।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম কোনো একক দেশের সমস্যা নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির দায়িত্ব। অনতিবিলম্বে ইজরায়েলকে তার হত্যা নীতি পরিহার করতে হবে। ফিলিস্তিনের গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সকল মহলকে ইজরায়েলের যুদ্ধনীতি পরিহারে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তির পক্ষে দাড়াতে হবে। গাজা, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের গণহত্যার সাথে জড়িত সকল পক্ষের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”

সংহতি মিছিলে উপস্থিত ছিলেন জেলা সহ-সভাপতি সৌরভ সেন, সাধারণ সম্পাদক সৃজয় সাহা, সহ-সাধারণ সম্পাদক ইউশা ইসলাম ও তাইরান আবাবিল রোজা, সাংগঠনিক সম্পাদক মৌমিতা নূরসহ জেলা ও শাখা কমিটির অন্যান্য সংগঠক-কর্মীরা এবং নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পর্যায়ের সাধারণ ছাত্র-জনতা।

ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী জনগণের পক্ষে সংহতি জানিয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

এদিকে, সোনারগাঁয়ে ফজলুল হক উইমেন্স কলেজে এক বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ।

এছাড়া ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য নারায়ণগঞ্জে জেলা প্রশাসক কার্যালয় বিশেষ মোনাজাত এর আয়োজন করা হয়। দোয়ায় অংশ নেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা, সিভিল সার্জন ডা. এ এফ এম মুশিউর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) তাসমিন আক্তার, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য মাওলানা মইনুদ্দিন আহমাদসহ প্রমুখ। বৈশাখ আয়োজনের প্রস্তুতি সভায় এই দোয়ার আয়োজন করা হয়।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলার প্রতিবাদে গণসংহতি আন্দোলন সোমবার বিকাল ৫ টায় নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাব সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মহানগর কমিটির সমন্বয়কারী নিয়ামুর রশীদ বিপ্লব এবং জাহিদ সুজন সঞ্চালনা করেন।

বিক্ষোভ সমাবেশে তরিকুল সুজন বলেন, “ফিলিস্তিনের জনগণ আমাদের স্বজন, আর ইসরায়েল একটি দখলদার রাষ্ট্র। ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হল ইউরোপীয় দখলদারি ঔপনিবেশিক প্রকল্পের অংশ। প্যালেস্টাইনের নিরস্ত্র মানুষের ওপর এই বর্বরোচিত হামলা হচ্ছে ফিলিস্তিনকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার এক জায়নবাদী নীলনকশা।

নিয়ামুর রশীদ বিপ্লব সভাপতির বক্তব্যে বলেন, “জাতিসংঘের ১৯২টি দেশের মধ্যে ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। আমরা জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানাই, ফিলিস্তিনের গণহত্যা বন্ধ করতে হবে এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।”

বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন গণসংহতি আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলার নির্বাহী সমন্বয়কারী অঞ্জন দাস, মহানগরের নির্বাহী সমন্বয়কারী পপি রানী সরকার, জেলা কমিটির অর্থ সম্পাদক নাজমা বেগম, জেলা কমিটির প্রচার সম্পাদক শুভ দেব, জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রাইসুল রাব্বি, জেলা কমিটির সদস্য আলমগীর হোসেন আলম, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির জেলা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল আল মামুন, মহানগর কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মেহেদী হাসান উজ্জ্বল, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউর রহমান জয়, ১৮ নং ওয়ার্ড কমিটির আহ্বায়ক শুক্কুর মাহমুদ জুয়েল প্রমুখ।

গাজায় ইসরায়েল কর্তৃক সংঘটিত নৃশংস গণহত্যা ও বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর। বাদ আসর শহরের ডিআইটি মসজিদ থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদিক্ষন কওে চাষাড়া গিয়ে শেষ হয়। এতে নেতৃত্ব দেন মহানগর জামায়াতের আমীর মাওলানা আবদুল জব্বার।

বিক্ষোভ পূর্ব এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মাওলানা আবদুল জব্বার বলেন, আজ আমরা গভীরভাবে ব্যথিত ও মর্মাহত। মানবতার ইতিহাসে এর চেয়ে নৃশংস বর্বরতা আর হতে পারে না। ইসরায়েল অবিচার ও অন্যায়ের মাধ্যমে নিরীহ, নিরাপরাধ ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। আমাদের দেহ বাংলাদেশে, কিন্তু মন পড়ে আছে ফিলিস্তিনে।

সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও মহানগরীর সাবেক আমীর মাওলানা মঈন উদ্দিন আহমাদ। বিক্ষোভ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল কাইয়ুম, মহানগর সেক্রেটারি ইঞ্জিনিয়ার মানোয়ার হোসাইন, সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ জামাল হোসাইন, এইচ এম নাসির উদ্দিন, কর্মপরিষদ সদস্য মোখলেসুর রহমান, মাওলানা ওমর ফারুক, সাঈদ তালুকদার, প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের দায়িত্বশীল হাফেজ আবদুল মোমিনসহ শত শত ধর্মপ্রাণ মুসল্লি।

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মিছিল নিয়ে চাষাঢ়া শহীদ মিনারে জড়ো হন শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

বেলা পৌনে ১১টার দিকে চাষাঢ়া অবরোধ করা হয়। এতে নারায়ণগঞ্জ শহরের সঙ্গে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও আদমজী এলাকার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবরোধকালে শিক্ষার্থীরা গাজাবাসী ও ফিলিস্তিনের পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। জাতীয় নাগরিক পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অংশ নিতে দেখা গেছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, গাজাবাসীর ওপর ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে এই কর্মসূচি আহ্বান করা হয়েছে। বিপুলসংখ্যক লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছির আহমেদ বলেন, গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে।

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান বন্ধের দাবিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ-মিছিল শুরু হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা অবিলম্বে গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ এবং সেখানে ত্রাণ ও মানবিক সহায়তার প্রবাহ স্বাভাবিক করার দাবি জানাচ্ছেন।

শনিবার গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার মানুষ। এই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মুসলিম, খ্রিস্টানদের পাশাপাশি অনেক ইহুদি শান্তিকামী সংস্থার প্রতিনিধিরাও ছিলেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে তুরস্কের রাষ্ট্রায়ত্ব বার্তাসংস্থা আনাদোলু এজেন্সি জানিয়েছে, প্যালেস্টাইনিয়ান ইউথ মুভমেন্ট, দ্য পিপল’স ফোরাম, জিউয়িশ ভয়েস ফর পিস, আনসার কোয়ালিশনসহ ৩ শতাধিক সংস্থার উদ্যোগে হয়েছে এই মিছিল। মিছিলটি ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ সবগুলোর সড়ক প্রদক্ষিণ করেছে।

আরও পড়ুন