কবি নির্মলেন্দু গুণ এর স্মৃতিচারনা

“হেলাল হাফিজ একটি ছোট্ট ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসছে

বাংলা বাজার বার্তা

প্রকাশ: ২২:৪৩, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ | আপডেট: ২৩:২৫, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪

“হেলাল হাফিজ একটি ছোট্ট ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসছে

অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে ১৩ ডিসেম্বর কবি হেলাল হাফিজ চির অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন। কবি বেঁচে থাকাকালে ইত্তেফাক, জনকন্ঠ ও সমকাল ও কালের খেয়ার মুখোমুখি হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় জানিয়েছেন তাঁর সাহিত্য, ব্যক্তিগত জীবন, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার কথা। সেসব জানা-অজানা কথা ও আলাপচারিতা আজ কেবলই স্মৃতি। কবি নির্মলেন্দু গুণ জলে আগুণ জ্বালানো কবিকে নিয়ে তার একটি গ্রন্থে স্মৃতিচারণ করেছিলেন। সেই স্মৃতিচারণ আজকে পত্রস্থ করা হলোৃ..

হেলাল কি বেঁচে আছে? রাস্তায় টহলরত পাকিস্তানি সেনাদের যথাসম্ভব এড়িয়ে ২৭ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমরা হেলালের সন্ধানে জহুর হলের ভেতরে প্রবেশ করি। অনেকেই প্রাণের ভয়ে সেখানে প্রবেশ করার সাহস পাচ্ছিল না। সামান্য কিছু লোক তখন সেখানে জড়ো হয়েছিল। আমরা এগিয়ে যাই। গিয়ে দেখি, মাঠের একপাশে বেশ ক’টি মৃতদেহ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের দেহ রক্তাক্ত। মুখ যন্ত্রণাবিকৃত ও আগুনে ঝলসানো। ভালো করে চেনা যায় না।

দেখলাম, মৃতদের মধ্যে আমাদের প্রত্যাশিত কবি হেলাল হাফিজ নেই; কিন্তু আমাদের আরেক বন্ধু আছে, তার নামও হেলাল। সে ছিল ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক চিশতি শাহ হেলালুর রহমান। চিশতিও কবিতা লিখত। দু’দিন আগেও কবিতা নিয়ে ওর সঙ্গে আমার কথাকাটাকাটি হয়েছিল শরীফের ক্যান্টিনে। আজ আমি ওর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে।

হলের সবুজ ঘাসের ওপর মোট ১২টি লাশ ছিল পাশাপাশি শায়িত। আমি গুনেছিলাম। অন্যদের মধ্যে হলের ছাত্র ছাড়াও ছিল হলের কিছু কর্মচারী। মনে পড়ছিল ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি আবদুল গনি রোডে পুলিশের গুলিতে নিহত কিশোর শহীদ মতিউরের কথা। মতিউরের জানাজা হয়েছিল এই হলের মাঠে। সেদিন ছিল মাঠভর্তি মানুষ। আজ ওই একই মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে আছে এক ডজন যুবকের লাশ, কিন্তু সেখানে কেউ আসছে না। সেখানে আজ আর জানাজার কোনো আয়োজন নেই। ওদের নামও কেউ জানবে না কোনোদিন। ওই মৃতের সারিতে হেলাল হাফিজকে না দেখে আমরা খুশি। ওর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ল।

তখনই হঠাৎ হলগেটের দিকে তাকিয়ে দেখি, হলের ভেতর থেকে হেলাল হাফিজ একটি ছোট্ট ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসছে। হ্যাঁ, হেলাল হাফিজই তো! আমরা দু’জন ছুটে গিয়ে হেলাল হাফিজকে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরি। আমাদের তিনজনের চোখেই যমের চোখে ধুলো দিয়ে বেঁচে যাওয়ার আনন্দাশ্রু। পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫ মার্চের নির্বিচার নরবলিযজ্ঞের পর ২৭ মার্চ যখন দুই ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য-আইন শিথিল করা হয়, তখন ঢাকার মানুষ যে যে-দিক দিয়ে পারে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে পালিয়ে যাচ্ছিল। আমিও ছিলাম তাদেরই একজন। পিঁপড়ের সারির মতো দলবেঁধে বুড়িগঙ্গা নদী পেরোনোর জন্য ধাবমান মানুষের ওই সন্ত্রস্ত-দৃশ্যটি যারা সেদিন দেখেছেন, যারা নিজেরাই ছিলেন ওই করুণ দৃশ্যের কুশীলব, তারা কোনোদিনই তা ভুলতে পারবেন না।

আমি চোখ বন্ধ করলে এখনও ওই দৃশ্যটি স্পষ্ট দেখতে পাই। পরবর্তীকালে দেশত্যাগী শরণার্থীদের ভারত সীমান্তমুখী আরও দীর্ঘ, আরও ভয়াবহ মিছিলের দৃশ্য এসে ওই ছবিটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল বটে; কিন্তু ২৭ মার্চের ঢাকা ছেড়ে পালানো মানুষের মিছিলের দৃশ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল একাত্তরের সেই ট্র্যাজেডির। এর আগে ঢাকার মানুষ কখনও এভাবে শত্রুর তাড়া খেয়ে তাদের প্রিয় নগরী ছেড়ে দলবেঁধে পালিয়েছে– আমাদের ইতিহাসে তেমন নজির নেই।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথিত আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক সেনাবাহিনীর ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির ক্যান্টনমেন্ট বলে বিবেচিত ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা জহুর হলে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। তারা ধারণা করেছিল, জগন্নাথ হল ও জহুর হল থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ আসতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে [১৯৭১] মার্চের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ওই দুই হলের মাঠে ছাত্রদের সামরিক ট্রেনিং দেওয়া হতো। ফলে ওই হল দুটিতে পাকিস্তানি সেনা আক্রমণের ভয়াবহতা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।

আমরা আমাদের নিউ পল্টনের মেসে বসে ওই হলে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের খবর পাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠছিল পুরো হল এলাকাটি। আমরা ওইসব রক্তমারি প্রাণ কাঁপানো শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। হলের আগুনও আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার অনুজপ্রতিম তরুণ কবি হেলাল হাফিজ তখন ওই হলে থাকত। আমি, নজরুল আর আবুল হাসান বহুদিন হেলালের রুমে রাত্রি যাপন করেছি। আমরা হেলালের জন্য খুব চিন্তিত বোধ করি। হলে থাকলে তার পক্ষে মরণ এড়ানো কঠিন হওয়ারই কথা।

তাড়াতে তাড়াতে তুমি কতদূর নেবে?

এইতো আবার আমি ফিরে দাঁড়িয়েছি।’

আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ তখন (নভেম্বর ১৯৭০) বেরিয়ে গেছে। আমার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো লেখার জন্য আমি যখন মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম, তখন পাকিস্তানি সেনাদের তাড়া খেয়ে ঢাকা ছেড়ে পালানো মানুষের সন্ত্রস্ত মিছিলের ভেতরে নিজেকে আবিষ্কার করে, উপরে বর্ণিত পঙ্‌ক্তি দুটো হঠাৎ করেই আমার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো। আমার দুই সঙ্গী বন্ধু নজরুল ইসলাম শাহ ও অনুজপ্রতিম হেলাল হাফিজ (হেলাল তখনও কবিতা লিখতে শুরু করেনি, লিখব লিখব বলে ভাব করছে) আমার কবিতার পঙ্‌ক্তি দুটি শুনে বলল, বাহ বেশ চমৎকার! এই সময়ের জন্য এর চেয়ে সংগত উচ্চারণ আর কিছুই হতে পারে না। নজরুল বলল, কবিতাটা লিখে ফেল দোস্ত। হেলালও নজরুলের কথায় সায় দিলে কবিতাটি লেখা হয়ে গেল, মনে মনে।

সম্পর্কিত বিষয়:

আরও পড়ুন