আমাদের ভ্রান্তি বিলাস
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে নাকি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ?
আহমদ তমিজউদ্দিন :
প্রকাশ: ১৩:০৩, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | আপডেট: ১৬:১০, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব জুড়ে যখন লক্ষ কোটি মানুষ অসম যুদ্ধের শিকার হয়ে বাস্তুহারা, যখন হিংসা-বিদ্বেষ বারুদের গন্ধ ভরা পৃথিবীতে নিপীড়িত ও অসহায়মানুষ দিনযাপনের গ্লানি নিয়ে মানবেতন জীবন যাপন করছে। তখন আমাদের দেশ সহ বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এ দিনটিতে এক শ্রেণের তরুণ-তরুণী, যুবক যুবতী নানা রঙ এর পোষাক পড়ে হাতে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে পরস্পর শুভেচ্ছা বা ভালোবাসা বিনিময় করছে।
ইতিহাসে সেন্ট ভালেন্টাইন ডে সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রথমত রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস এর শাসনামতেল জনগণকে খ্রিস্টপূর্ব ত্যাগ করার আদেশ জারি করলে একজন যাজক/বিশপ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের এ আহবান প্রত্যাখ্যান করে। তাকে আটক করে ২৭০ খ্রিস্টাব্দর ১৪ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দ্বিতীয়ত, রোমকদের দেবী লেসিয়াসের পবিত্র দিন। এই দিন তিনি দুটি শিশুকে দুধ পান করিয়েছিলেন। তৃতীয় মতটি হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি রোমানদের বিবাহ দেবী ‘ইউনু’র পবিত্র বিবাহের শুভ দিন। চতুর্থ বর্ণনাটি হচ্ছে রোম সম্রাট ক্লাডিয়াস একটি বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করার ঘোষণা দিয়ে লক্ষ্য করলেন, তার সেনাবাহিনীতে বিবাহিত পুরুষ সদস্যরা এব্যাপারে অনাসক্ত। এতে তিনি যুবকদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ করে এক রাজকীয় ফরমান জারি করেন। এসময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক এক যুবক যাজক/ বিশপ এ ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করে গোপনে এক কারারক্ষীর মেয়েকে বিয়ে করেন। এ খবর সম্রাটের কাছে পৌঁছলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড দন্ডিত করে তা কার্যকরী করা হয়। মূলত এদিবসটি ছিল প্রাচীন ইউরোপীয় গ্রিক ও রোমান পুত্তলিকদের একটি ধমীয় দিবস। ইতিহাস রয়েছে ১৮’শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত খোদ রোম অর্থাৎ ইটালীতে এদিবসটি অনৈতিকতার অভিযোগে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত সেখানে উদযাপন নিষিদ্ধ ছিল।
আমাদের দেশে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন ‘যায় যায় দিন’পত্রিকার সম্পাদক বয়োবৃদ্ধ সাংবাদিক শফিক রেহমান এ দিবসটিকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আখ্যায়িত করে চূড়ান্তভাবে এর আবির্ভাব ঘটান। তিনি ভালোবাসা দিবস প্রচারের লক্ষ্যে তৎকালীন বিটিভিতে ‘লাল গোলাপ’ নামক একটি অনুষ্ঠান প্রচার ও উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি সেসময় ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামীতে দেশে একটি ভালোবাসা মন্ত্রণালয় খোলা হবে।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
তোমরা বলে দিবস-রজনী-ভালোবাসা ভালোবাসা
সখি, ভালোবাসা কারে কয়
সেকি কেবলই যাতনাময়
সেকি কেবলই চোখের জল
সেকি কেবলই দুঃখের শ্বাস
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ নর-নারীর ভালোবাসাতে কেবলই দুঃখ,যাতনা ও চোখের জলের সন্ধান পেয়েছেন। তিনি আরো লিখেছেন, প্রেমের আনন্দ পেয়েছেন, তিনি আরো লেখেন, প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পকাল কিন্তু বেদনা থাকে সারাজীবন। আমাদের একটি আধুনিক গানও আছে, প্রেমের অপর নাম বেদনা/ সেকি তুমি বোঝনা?
আমাদের দেশ, সমাজ ও বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে প্রেম ও ভালোবাসার মর্মস্পর্শী বিভিন্ন কাহিনী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এদের মধ্যে, লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, চন্ডিদাস-রজকিনি, দেবদাস-পার্বতী, মুঘল যুবরাজ সেলিম-আনারকলির প্রেমকাহিনী ছাড়াও পাশ্চাত্যে কোন এক কৃষক কন্যার ভালোবাসায় আসক্ত সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ডের সিংহান ত্যাগের আলোচিত কাহিনী সারাবিশ্বে কিংবদন্তী হয়ে রয়েছে। ভালোবাসার জন্য তারা নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে ত্যাগ করে মৃত্যুকেও তুচ্ছজ্ঞান করেছেন। বিশ্ব জুড়ে প্রেম ও ভালোবাসার কাহিনীগুলোর অধিকাংশই মিলনাত্মক নয়, বিয়োগাত্মক বটে। যদিও ভালোবাসা হচ্ছে পৃথিবীর এক মায়াময় মধূর মানবিক অনুভূতির নাম। ভালোবাসা হচ্ছে প্রতিদিনের প্রতিটি পরিবারের জন্য এক অনাবিল নিত্যসঙ্গীর নাম। পাশ্চাত্যের ধনবাদী সামাজ্র্যের যারা আজ ঘটনা করে যে ভ্যালেন্টাইন ডে পারন করছেন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তাদের ঘর-সংসারে ভালোবাসা নেই। ভালোবাসা এমন এক প্রাচুর্য্যময় জীবনে একরাশ জ্বালা। আর জীবন জটিলতার নাম। পরিণাম তাদের ভালোবাসা পরিণত হয়েছে ধর-ছাড়া ও ছাড়-ধর নতুন জীবন সঙ্গীর নাম। যেখানে এমন ভালোবাসার জ্বালায় শুরু হয়ে পরস্পর বন্ধন মুক্তির আন্দোলন। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ্য এক সময়ের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী, বর্তমান বিশ্বের দশজন ধনকুবেরের একজন বিল গেটস এর কথা। এক পরিসংখ্যানে বরা হয়েছে, বিল গেটস এর যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তিনি যদি প্রতিদিন দশ লাখ ডলার করে খরচ করেন তবে তা শেষ হতে ২১৮ বছর লাগবে। বিল গেটস এর বয়স এখন ৬৯ বছর। তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর সংসার করার পর তার সংসারে ভালোবাসা না থাকার কারণে কিছুদিন আগে স্ত্রী মেলিন্ডার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করেছেন। তাদের সংসারে তিনটি সন্তান রয়েছে। তাদের বড় মেয়েটি বিবাহিতা। তাদের স্বামী-স্ত্রীর যৌথভাবে অর্জিত সম্পদ সংসারে ভালোবাসা দিতে পারেনি। তাদের উভয়ের জীবনে বয়ফ্রেন্ড-গালফ্রেন্ড এর অস্তিত্ব ছিল নিত্যদিন।
আদিকাল থেকেই নর-নারীর মধ্যে প্রেম বলি কিংবা ভালোবাসা বিল তা মরে বাইরে নিত্যপ্রবাহ ছিল, ছিল একের প্রতি অপরের এক অপার্থিব ভালোবাসার দুর্বার আকর্ষণ। তার প্রকাশ কোন নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণে সীমাবদ্ধ ছিলনা। এ ভালোবাসার আকর্ষণ ছিল স্রষ্ঠা প্রদত্ত। এজন্যেই বলা হয়-স্বর্গ হতে আসে প্রেম, স্বর্গে চলে যায়।
আদতে ভালোবাসা অপাথিৃব হলেও কালচক্রে এখন তা অনেকটাই পার্থিব- মেকিতে রূপান্তর হয়েছে। ফলে দেখা যায় কেও ভালোবেসে বিয়ে করলেও পরস্পর বোঝাপড়ার অভাবে তা বিচ্ছেদে পরিণত হয়েছেন এমন নজীর অনেক আছে। তাইতো আমাদের দেশের এক আধুনিক কবি লিখিছেন, প্রেম করতে কি কি লাগে সে তো আমি জানি, মুখে লাগে চাপার জোর পকেট ভরা মানি। বর্তমান কালের ভালোবাসা সম্পর্কে কেউ আবার ঠাট্টা করে লিখেছেন, সাদা-কালো, লাল-নীল ভালোবাসার রঙ, ভালোবেসে কেউ আবার দেখায় কত ঢঙ। ভালোবাসা কিছু মানুষকে কি পরিমাণ মজনু(পাগল) বা উন্মাদ করে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য করে-তারই নমুনা হিসেবে ভারতের একটি হিন্দি গানে ফুটে উঠেছে। এক প্রেম ভিখারি বলছে, না মাঙ্গে ম্যায় সোনা-চান্দি/ মাঙ্গে তেরি দর্শন দেবী/ তেরি দুয়ার সে খাড়া এক যোগী/ তেরি লিয়ে জাগ ছোড়া/ তেরি লিয়ে গীত ছোড়া/ম্যায় ছোড় দিয়া ভগবান।
আমাদের দেশে সস্তা ভালোবাসায় আপ্লুত এক শ্রেণির প্রেমিক-প্রেমিকাদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে দেশের প্রখ্যাত ছড়াকার মরহুম রফিকুল হক (দাদু ভাই) তার রিদমের ভ্যালেন্টাইন নামক ছড়ায় লিখেছেন, সারাজীবন ‘ছ্যাক’খেয়ে যার মেজাজ টোয়েন্টি নাইন/তার কাছে হায় কিসের ফাল্গুন-কিসের ভ্যালেন্টাইন।
বলা যায়, এদিবসটি যদি ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়-তাহলে এর ইংরেজি হওয়া উচিৎ ছিল লাভার ডে বা লাভার ফেস্টিভাল। আমরা যে দিবসটি ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদযাপন করছি সেটির উৎপত্তিগত নাম হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে, এর প্রথম শব্দটি সেন্ট বা সাধু হিসেবে তার আসল পরিচয় জানান দিচ্ছে। ফলে এটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের সামাজিক বা ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে মেলেনা। এদিবসটি পশ্চিমা থেকে আমদানীকৃত সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে, খ্রিস্ট ধর্মের মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ। একটি জাতির জন্য নিজস্ব সংস্কৃতি ছেড়ে বিজাতীয় সংস্কৃতির অবাধ চর্চা আমাদের জাতীয় দেউলিয়াত্ব ও ভ্রান্তিবিলাস নয় কি ? এব্যাপারে আমাদের সবাইকে সোচ্চার ও সচেতন হতে হবে।
লেখক : আইনজীবী ও সাংবাদিক