ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মহাসড়কে হাইওয়ে ডাকাতচক্রের আনাগোনা
বাংলাবাজার বার্তা ডেস্ক :
প্রকাশ: ০০:১৩, ২৪ মার্চ ২০২৫ | আপডেট: ০০:২৮, ২৫ মার্চ ২০২৫

পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মহাসড়কে ফের অপরাধীচক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক নজর এড়িয়ে ফের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আন্ত:জেলা ডাকাতচক্র হানা দিয়ে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। এবার ডাকাতচক্র ডিবি পুলিশ (গোয়েন্দা) এর ছদ্মবেশ ধরেছিল। ডাকাতির ঘটনায় একই রাতে দিবা এন্টারপ্রাইজ নামক কোম্পানির ম্যানেজার মো. নাজিম উদ্দিন বাদী সোনারগাঁ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ- সার্কেল) আসিফ ইমাম জানান, আমি ঘটনার কথা শুনেছি। তবে আমি ছুটিতে থাকায় বিস্তারিত বলতে পারছি না। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মহাসড়কগুলোতে জননিরাপত্তা জোরদার করার দাবি উঠেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ অংশে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ফিল্মি স্টাইলে একটি বেসরকারি কোম্পানির ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ডাকাতি হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অস্ত্র ঠেকিয়ে তাদের টাকা নিয়ে যাওয়া হয়। শনিবার দুপুরে মহাসড়কের দড়িকান্দি ব্রিজ সংলগ্নে এই ঘটনা ঘটেছে।
অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হয়েছে, ঢাকার ভাটারা থানা এলাকার 'দিবা এন্টারপ্রাইজ' নামক একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মো. নাজিম উদ্দিন ও একই কোম্পানির মাইক্রোবাস চালক মামুন শেখ (৪৫) গতকাল শনিবার (১৫ মার্চ) দুপুরে ঢাকার মতিঝিল জীবন বীমা ভবনে থাকা সিটি ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা হতে ১ কোটি দশ লাখ টাকা উত্তোলন করে তাদেরই চাঁদপুরের দিবা এন্টারপ্রাইজ শাখার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
যাত্রাপথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রামগামী লেনের সোনারগাঁ উপজেলার দড়িকান্দি ব্রীজ পার হতেই পেছনে থাকা সিলভার রঙের একটি এক্সজিও ফিল্ডারযোগে অজ্ঞাতনামা ৬ সদস্যের একটি ডাকাত গ্রুপ তাদের গাড়ির গতিরোধ করে। পরে ডাকাত সদস্যরা নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগী ম্যানেজারকে গাড়িটি তল্লাশির কথা বলেন।
একপর্যায়ে ডাকাত সদস্যরা ভুক্তভোগীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চোখ বেধে ও হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে মাইক্রোবাসযোগে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে অপরিচিত একটি স্থানে থামিয়ে কোম্পানির মাইক্রোবাসে থাকা দুটি ব্যাগের ১ কোটি ১০ লাখ ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে থাকা মূল্যবান জিনিস ডাকাতি করে চলে যান।
ছুটিরদিন হওয়া সত্বেও ব্যাংক হতে কোটি টাকা উত্তোলনের বিষয়টি জানতে অভিযোগের বাদী নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানিতে বিকাশের লেনদেন করা যায়। এটা শুধু সিটি ব্যাংকই করেন। আমাদের মালিক দেশের বাহিরে থাকায় উনার সই করা চেকের মাধ্যমে আমরা টাকা তুলেছি। এটা করা যায়।
তিনি বলেন, ৬ ডাকাতের একজন আমাদের গাড়িটি চালিয়ে আমাদেরকে বিভিন্ন স্থানে প্রায় আড়াই ঘন্টা ঘুরিয়ে তারপর সব নিয়ে গেছেন।
অবশেষে নারায়ণগঞ্জে হাইওয়ে ডাকাতচক্রের রহস্য উন্মোচিত হলো। এই চক্রের হোতা হলেন একজন শীর্ষ মাদক কারবারি। তার নাম মোহাম্মদ আলী। সে হাইওয়ে ডাকাতচক্রের আঞ্চলিক কমান্ডার। মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করতে করতে সকল অপরাধ সিন্ডিকেটের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে মোহাম্মদ আলী হয়ে উঠেছে একজন ভয়ংকর ডাকাত কমান্ডার। স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় এলাকার পরিবেশ পরিস্থিতি ও মানুষের গতিবিধি-সবই তার নখদর্পনে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ভয়ংকর ডাকাত কমান্ডার মোহাম্মদ আলীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
জানাগেছে, বন্দরের উত্তরাঞ্চলের শীর্ষ মাদক কারবারি মোহাম্মদ আলী অন্তরালে গড়ে তুলেছে এক ভয়ঙ্কর সংঘবদ্ধ ডাকাত দল । মোহাম্মদ আলী যাত্রীবাহী বাস ডাকাত দলের আঞ্চলিক কমান্ডার । তার নিয়ন্ত্রণে চালিয়ে যাচ্ছে র্যাব পরিচয়ে যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি। ঢাকা- চট্রগ্রাম মহাসড়কে লাঙ্গলবন্দ এলাকায় গত দেড় মাসে যাত্রীবাহী বাসে পৃথক তিনটি ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে এ বাহিনী।
বন্দর থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি তরিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে র্যাব পরিচয়ে যাত্রীবাহী বাসে ৩ টি ডাকাতির ঘটনায় আঞ্চলিক কমান্ডার মোহাম্মদ আলী সহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনটি ঘটনা ঘটিয়েছে বলে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তি প্রদান করে তারা। গ্রেপ্তারকৃত সকলের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও দুই প্রবাসী সহ তিন ব্যবসায়ীকে বাস থেকে টেনে হেঁচড়ে নামিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা লুটে নেয়ার ঘটনা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তি মুলক জবানবন্দি দিয়েছে মোহাম্মদ আলী। দুই দিনের রিমান্ড শেষে গত বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয়।
গত ১৪ জানুয়ারি দিন দুপুরে প্রকাশ্যে ২১ লাখ টাকা সহ দুই প্রবাসীকে বাস থেকে টেনে হেঁচড়ে নামানোর ধারণকৃত একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে টনক নড়ে পুলিশের। ধারণকৃত ওই ভিডিওতে থাকা শহিদুল ইসলাম মাঝি (৫৪), নেসার উদ্দিন বাচ্চু (৫২) ও বাবুল (৪০) নামে তিন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারি অফিসার এসআই জহিরুল ইসলাম।
জানাগেছে, আবু হানিফ (৩৫) ও রাজিব ভূঁইয়া (৩৫) দুই প্রবাসী গত ১৪ জানুয়ারি ডুবাই থেকে বাংলাদেশে আসেন। বিমানবন্দর থেকে তারা একটি প্রাইভেটকার যোগে বাইতুল মোকাররম মার্কেটে এসে ডলার ভাঙ্গান। তার পর রাজধানী ফ্লাইওভার থেকে এশিয়া লাইন (১৪-৭৫৩৩) যাত্রীবাহী বাসে উঠে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হন তারা ।
দুপুর আড়াই টার দিকে ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের বন্দর থানাধীন জাঙ্গাল এলাকায় আব্দুল মোনেম লিমিটিড গেইটের সামনে বাসটি পৌঁছালে একটি সাদা রংয়ের হাইয়েজ বাসটি গতিরোধ করে ৩/৪ জন লোক র্যাবের কটি পরিহিত অবস্থায় বাসের ভেতর প্রবেশ করে। এরপর ডাকাতরা নিজেদের র্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে প্রবাসী রাজিব ভূইয়া ও আবু হানিফের বিরুদ্ধে মামলা আছে বলে বাস থেকে নামিয়ে ডাকাতদের ব্যবহৃত হাইয়েজ গাড়িতে তুলে।
এ সময় প্রবাসীদের সঙ্গে থাকা কালো ও বুলু রংয়ের ব্যাগে থাকা নগদ ৫ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড, ২ হাজার অস্ট্রেলিয়ান পাউন্ড,২টি মোবাইল ফোন, ৩টি পাসপোর্ট সহ ২১ লাখ টাকার মালামাল জোর পূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকে ডেমরা এলাকার একটি পরিত্যাক্ত রাস্তার পাশে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এঘটনায় প্রবাসী আবু হানিফ বাদী হয়ে বন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। গত ৪ জানুয়ারি কুমিল্লা দেবিদ্ধারের মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম(৫০) নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী ৬৫ লাখ নিয়ে এশিয়া লাইন পরিবহনে ঢাকা আসার পথে লাঙ্গলবন্দ এলাকায় পৌঁছালে র্যাব পরিচয়ে বাস নামিয়ে একই কায়দা সর্বস্ব লুটে নিয়ে ডাকাতদল।
২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর রাতে চট্রগ্রাম সদর থানার ২২ গোলাপ সিং লেন এলাকার মৃত সুকুমার রায়ের ছেলে চন্দন রায় (৫৩) ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম যাচ্ছিলেন। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের বন্দরের লাঙ্গলবন্দ পৌঁছালে ৪০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার সহ হানিফ পরিবহন থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় ডাকাতরা। পরে ব্রিজের নিচে ফেলে রেখে গেলে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে পুলিশের সহযোগিতায় বন্দর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।