গভীর গহন থেকে জালালুদ্দিন রুমী
রফিউর রাব্বি
প্রকাশ: ২২:২০, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
জালালুদ্দিন রুমী ১২৭৩ খৃস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর শবযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন মুসলিম-ইহুদী-খৃস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ। অংশ নিয়েছিলেন স্বয়ং সালজুকের শাসনকর্তা। তিনি শবযাত্রায় অংশ নেয়া ইহুদী ও খৃস্টানদের প্রশ্ন করেছিলেন, মাওলানা রুমীর সাথে কী সম্পর্ক যা তোমাদেরকেও এই শোকের অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছে? উত্তরে তারা শাসনকর্তাকে বলেছিলেন, ‘মৃত ব্যক্তি যদি আপনাদের মুহাম্মদ (সঃ) হন, তাহলে তিনি আমাদের যীশু ও মূসা।’
সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে যিনি আদি ও অন্তহীন, পরম ও অসীম সত্ত্বা, যিনি সমাসীন হয়েছেন সীমাবদ্ধ মানুষে- সে সত্যের উপলব্ধি জালালুদ্দিন রুমীকে বিস্মিত করেছে, তন্ময় করেছে, বিমোহিত করেছে। তিনি নিমজ্জিত হয়েছেন, দ্রবীভূত হয়েছেন যেমনি জলে চিনি বিলীন হয়ে যায়। রুমীর কবিতার ছত্রে ছত্রে সে উপলব্ধি ও দর্শনেরই প্রতিফলন ঘটেছে।
ফার্সী ভাষায় রচিত গ্রন্থের মধ্যে সাধারণত চারটি গ্রন্থকে বিখ্যাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’, শেখ শাদীর ‘গুলিস্তাঁ’, রুমীর ‘মসনবী’ এবং হাফিজ-এর ‘দিওয়ান’। এসবের মধ্যে মসনবী সারাবিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত গ্রন্থ। মসনবীকে ফার্সী ভাষার কোরআন বলেও কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। মসনবীতে সুফী কাব্যের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে। এতে রয়েছে ধর্মের শিকড়, প্রকৃতি ও চিরন্তন জ্ঞানের রহস্য। রূপকে উপস্থাপিত ছয় খণ্ডের কাব্য মসনবী রচনায় রুমীর সময় লেগেছে দশ বছর।
১২০৭ খৃস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর বলখ্-এ জালালুদ্দিন রুমীর জন্ম। পিতা শেখ বাহাউদ্দিন বলখী সে সময়ের খ্যাতিমান ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও শিক্ষক ছিলেন। তিনি অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। সকল বিষয়ের উপরেই অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল। যে কোন বিষয়ের উপরই তিনি অনায়াসে বক্তৃতা করতে পারতেন। তাঁর পান্ডিত্যের কথা তদ্ঞ্চলের সর্বত্র প্রচারিত ছিল। বাহাউদ্দিন তৎকালীন স্থানীয় শাসক খোয়ারিজম শাহ-এর আত্মীয় ছিলেন। খোয়ারিহম শাহ পরবর্তী সময়ে বাহাউদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর বাহাউদ্দিনের বংশের উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ ছিলেন। সে সময় বলখ্-এ বাস করতেন বিখ্যাত দার্শনিক ও পন্ডিত ফখরুদ্দিন রাজী। তিনিও খোয়ারিজম শাহ-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু বাহাউদ্দিন ফখরুদ্দিনের দর্শন ও মতবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। একসময় এ বিরোধ এতটাই চরমে পৌঁছে যে, বাহাউদ্দিন তাঁর জন্মভূমি বলখ্ ছাড়তে বাধ্য হন। তখন জালালুদ্দিন রুমীর বয়স পাঁচ বছর।
রুমী জীবনের দীর্ঘ সময় কেনিয়ায় অতিবাহিত করেছেন। এটি ছিল তুরস্কের পশ্চিমে অবস্থিত এশিয়া-মাইনর অঞ্চলের অন্তর্গত। সে সময় এ অঞ্চলকে রোমানদের ভূমি বা রুম বলে অভিহিত করা হতো। আর তাই জালালুদ্দিনের নামের সাথে রুমী নামটি যুক্ত হয়ে পরবর্তীকালে রুমী নামেই তিনি সমধিক পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর নামের পূর্বে ‘মাওলানা’ শব্দটি যুক্ত করা হয়। মাওলানা আরবী শব্দ। যার অর্থ সম্মানিত শিক্ষক। রুমীর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত তৈরি হয় পিতার তত্ত্বাবধানে। দর্শনের মৌলিক তত্ত্ব ও আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা তিনি পিতার কাছ থেকেই গ্রহণ করেছেন।
পরে পিতা তাঁর অনুসারী সাইয়েদ বোরহানউদ্দিন মোহাক্কিক’কে পুত্র জালালুদ্দিন রুমীর শিক্ষাদানের জন্য নিযুক্ত করেন। রুমী বোরহানউদ্দিনের কাছে ধর্মীয় ও জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। বোরহানউদ্দিনই রুমীকে সুফী তত্ত্বজ্ঞানে উজ্জ্বীবিত করেছেন। রুমী দামেশ্ক ও আলেপ্পো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন। ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন, তর্কশাস্ত্র ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি এখান থেকেই জ্ঞান লাভ করেন। আরবী, ফার্সী, তুর্কী ও গ্রীক এই চারটি ভাষায়ই সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন রুমী। এসবগুলো ভাষাতেই তিনি একাধারে কবিতা লিখতে পারতেন।
শামসুদ্দিন তাবরেজী বা শামস-ই-তাব্রিজ-এর সাথে জালালুদ্দিন রুমীর সাক্ষাতের পরে রুমীর চিন্তার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে থাকে। শামস-ই-তাব্রিজ আজারবাইজানের অন্তর্গত তাব্রিজ শহরের অধিবাসী। ১১৮৫ খৃস্টাব্দে তাঁর জন্ম। প্রকৃত নাম মুহাম্মদ শামসুদ্দিন। শামসুদ্দিন আরবী শব্দ। যার অর্থ দিনের সূর্য; আবার শামস নামে আরবে একটি পাখি ছিল যা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াত। শামস-ই-তাব্রিজ দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়াতেন বলেই ভ্রাম্যমান সে পাখির সাথে মিলিয়ে এবং তাব্রিজ শহরের অধিবাসী হওয়ায় তাঁর এই নাম বলে অনেকেই মনে করেন।
প্রচলিত শিক্ষার বাইরে ছিল তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞান। জ্ঞান ও শক্তিতে তিনি এমনি পর্যায়ে পৌঁছেন যে, প্রচণ্ড তৃষ্ণা, অতৃপ্তি ও ব্যাকুলতায় সারাক্ষণ অস্থির থাকতেন। প্রকৃত বন্ধুর অন্বেষণে দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। নিজের প্রকৃত অবস্থা গোপন রাখতে বণিকের বেশে ঘুরে বেড়াতেন। শামস-ই-তাব্রিজের সাথে পরিচয়ের পর যেন খোলসের আচ্ছাদন খুলে ফেললেন রুমী। বায়েজীদ বোস্তামী যেমনি বলেছেন, ‘সাপ যেমন তার খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আমিও তেমনি বায়েজীদ সত্ত্বার মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে চতুর্দিকে তাকালাম। দেখলাম প্রেমিক, প্রণয়-পাত্র ও প্রেম সবই এক।
মিলনের জগতে সবই এক হতে পারে।’ রুমীর কাছে তেমনি জাগতিক ও প্রচলিত সকল শিক্ষা, গ্রন্থ, পুঁথিপত্র তখন অসার ও মূল্যহীন হয়ে যায়। জ্ঞানের অতিউচ্চতর শৃঙ্গে তখন তিনি আরোহন করেছেন। তাব্রিজের সাথে পরিচয় হওয়ায় আগে যেখানে রুমী গান-গজল থেকে দূরে থাকতেন, পরিচয় হওয়ার পরে রুমী সারাক্ষণ প্রেমে মশগুল হয়ে গজল ও শায়েরে ডুবে থাকতেন। শিক্ষকতা, বক্তৃতা, ওয়াজ-নসিহত, ফতোয়া লেখা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলেন। তিনি বললেন, ‘সব গ্রন্থ, পুঁথিপত্র যত সাগরে নিক্ষেপ করো, আগুনে পুড়িয়ে দাও।’
শামস-ই-তাব্রিজ যেন রুমীর ঘি-মাখা শুকনো কাঠে আগুন ধরিয়ে দিলেন। দাউ দাউ সে আগুনে চারপাশ যেমনি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলো পাশাপাশি ভষ্মীভূত হতে থাকলো আচার, লৌকিকতা আর ধর্মের পোশাকী আনুষ্ঠানিকতা। রুমী সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে তাব্রিজকে নিয়ে মত্ত হলেন। রুমী তাব্রিজকে নিয়ে ‘দিওয়ান-ই-শামস’ গ্রন্থ রচনা করলেন যা ‘কুল্লিয়াতে শামস-ই-তাব্রিজ’ নামে প্রকাশিত হয়। দিওয়ান-ই-শামস-এ তিনি লিখেছেন,
বিশ্বের সম্পদ মৃতদেহেরই মতো,
এ মৃতদেহকে আমরা কুকুরের সামনে ফেলে দিয়েছি।
কোরআনের সারবস্তু আমরা বের করে নিয়েছি,
আর বাইরের খোলসটা দিয়েছি কুকুরদের।
মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত সকল জায়গায়
আমরা ছড়িয়ে দিয়েছি শাশ্বত উল্লাস ও আনন্দের বীজ।
তালি-দেওয়া জোব্বা, জায়নামাজ ও তস্বিহ,
আমরা পরিত্যাগ করেছি আত্মার সরাইখানায়।
ধার্মিকতার পোশাক, পাগড়ি ও জ্ঞানের গরিমা
নিক্ষেপ করেছি আমরা প্রবহমান নদীতে।
আকাক্সক্ষার ধনুকে দিব্যজ্ঞানের তীর সংযোজিত করে
স্থিরভাবে লক্ষভেদ করেছি আমরা।
শামস্-তাব্রিজ, তুমি সত্যি বলেছ-
আমরা নিক্ষেপ করেছি প্রেমের দৃষ্টি-
আত্মার প্রভুর উদ্দেশ্যে।১
দিওয়ান-ই-শামস্-এর বিভিন্ন কবিতায় সুফীতত্ত্বের অন্তর্নিহিত রহস্য বিবৃত হয়েছে। কোথাও তা উন্মোচিত আবার কোথাও অপ্রকাশ্য। শামস-ই-তাব্রিজ-এর সাথে পরিচয় হওয়ার পূর্বে রুমীর জীবন ছিল অসংখ্য মানুষের সাথে সম্পর্কিত, জৌলুসে। যেখানেই যেতেন বহু অনুসারী, গুণগ্রাহী ও বিদ্বান ব্যক্তিরা তাঁর সঙ্গী হতেন। তাব্রিজের সাথে পরিচয় হওয়ার পর রুমী সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে শুধু তাঁর সাথেই মশগুল থাকতেন।
রুমী বলেন, ‘সমগ্র রুমের অধিবাসী- রাজা, বাদশাহ্, ধনী, বণিক, ওলামা-মাশায়েখ এবং আমীর ওমরাহ্ যতদিন জালালুদ্দিনের দাস ছিল ততদিন জালালুদ্দিন ছিল মৌলবী জালালুদ্দিন কাউনাবী; কিন্তু যেদিন ক্রীতদাসরূপে নিজেকে শামস-ই-তাব্রিজের পায়ে সমর্পণ করলাম, সেদিন থেকে আমার নাম হল মাওলায়ে রুমী।’
এতে রুমীর অনুসারী, পুত্র-পরিজন তাব্রিজের উপর ক্ষিপ্ত হতে থাকল। সর্বত্র প্রচারিত হয় জাদুকর শামস-ই-তাব্রিজ রুমীকে জাদু করে বশ করে নিয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, একসময় তাব্রিজী রুমীকে না বলেই কাউনিয়া ছেড়ে দামেশ্ক চলে যান। তাব্রিজির শূন্যতা রুমীকে আরো ব্যাকুল করে তোলে। তাঁর নাওয়া-খাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি লিখলেন,
আমি ছিলাম যেন একটা খোলা মুক্তা
অকস্মাৎ যেন আশ্রয় নিলাম ঝিনুকের বুকে।
তাঁর করুণার সূর্যকিরণে আমি হয়ে উঠলাম উত্তপ্ত;
সেখান থেকে আবার আত্মপ্রকাশ করলাম সময়ে।
বিশ্বজনীন প্রজ্ঞার সাথে একবার আমার গোপন কথা হয়,
কিন্তু আবার আমি উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়ালাম
মরু-প্রান্তরে।
লক্ষ লক্ষ বছর আগে, বহু শতাব্দী পূর্বে-
এমন কি আদম-হাওয়ার আগেও ছিলাম আমি।
নীরব যারা, একদা তাদেরি মধ্যে ছিলাম আমি,
সে নীরবতা থেকেই আজ হয়ে উঠেছি সবাক মুখর।২
রুমীর এরকম অবস্থা দেখে তাঁর ছেলে ও অনুসারীরা শামস-ই-তাব্রিজকে খুঁজতে বের হন। দামেশ্ক থেকে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁদের এ মিলন খুব দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিছুদিন পরেই আরেক ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে স্থায়ী বিচ্ছেদ তৈরি হলো। এক সকালে শামস-ই-তাব্রিজের অন্তর্ধান ঘটে। পরে রুমী সকলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী বসে বিচ্ছেদগাঁথা গাইতেন, কবিতা আওড়াতেন, কখনোবা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠতেন। এসময় থেকে তিনি ‘মসনবী’ রচনা শুরু করেন।
মসনবীর শুরু হয়েছে এইভাবে,
‘কান পেতে শোন, বাঁশী কী বলে, কোন বিরহ-বিচ্ছেদের কথা বলে
বাঁশ বন থেকে যখন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে আমার কান্না ও আর্তনাদে তখন নারী-পুরুষ সকলে কেঁদেছে
বিরহ বেদনায় যাদের হৃদয় বিদীর্ণ, আমার প্রেম-বেদনা প্রকাশের জন্য প্রয়োজন তেমনি চূর্ণ-বিচূর্ণ হৃদয়
যে ব্যক্তি আপন কক্ষচ্যুত হয়েছে সে পুনরায় হারানো মিলনযুগ অন্বেষণ করে’-
পুরো মসনবী জুড়ে রয়েছে সুফীতত্ত্বের, ধর্মের ও সৃষ্টিতত্ত্বের মৌলিক নির্যাস। কিন্তু সবই প্রতীকী রূপে। মনসুর হাল্লাজ তাঁর ‘কিতাব আল তাওয়াসিন’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘যে বলে, “তার সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা আছে বলেই আমি তাকে জানি”- অজ্ঞতা কেবল একটি আবরণ এবং গুপ্তজ্ঞান আবরণকে ছাড়িয়ে যায়। তা যদি না হয় তবে তার কোন বাস্তবতা নেই।’ বাগদাদে একসময় মনসুর হাল্লাজের ‘আনা-আল-হক্ক’-এর সমালোচনা করে কেউ কেউ যখন প্রশ্ন তুললেন, হাল্লাজের ‘আমি’র সাথে ফারাওয়ের তফাৎ কই? জালালুদ্দিন রুমী তার উত্তরে বলেছেন, ‘ফারাও কেবল নিজেকে দেখেছিল যখন হাল্লাজ দেখেছিল কেবল শাশ্বতকে। তাই তাঁর দাবী অনুগ্রহ লাভ করেছিল আর ফারাওয়ের দাবী অভিশাপ বয়ে এসেছিল।’ হাল্লাজের পূর্বে বায়েজীদ বোস্তামীও এই ‘আমি’তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি হলাম মদ্যপানকারী, মদ্য এবং মদ্য পরিবেশক সাকীও।’
ধর্মের আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপের অসারত্ব উন্মোচন করেছেন রুমী। উন্মোচন করেছেন এর শাশ্বত রূপকে, সত্যকে। মূসা ও মেষপালক কবিতায় রুমি বলেছেন-
একদিন মুসা নবী শুনছিলেন রাস্তার ধারে বসে এক মেষপালক
প্রার্থনা করছে,
‘হে খোদা,
তুই কই? আমি তোরে সাহায্য করতে চাই- আমি তোর জুতা
সেলাই করতে চাই,
চুল আঁচড়ে দিতে চাই, তোর কাপড় কাচতে চাই, উঁকুন বাছতে চাই,
আমি তোরে দুধ খাওয়াইতে চাই। যখন তোর ঘুমাতে যাওয়ার
সময় হবে,
আমি তোর ছোট ছোট হাত-পায় চুমু খেতে চাই। আমি তোর ঘর-দুয়ার
ঝাড়ু দিয়ে সাফ রাখতে চাই। হে খোদা, আমার ছাগল-ভেড়া
সব তোর।
তোরে আমি যখন স্মরণ করি, তখন শুধু বলতে পারি
আই-ই-ই আর এ্যাঁ-এ্যাঁ-এ্যাঁ-এ্যাঁ।’
মুসা নবীর আর সহ্য হলো না
‘তুই কার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিস?’
‘যে আমারে বানাইছে,
যে বানাইছে এই দুনিয়াদারি আর আসমান।’
‘জুতা-মোজা নিয়া খোদার
লগে বাহাস চলে না! ছোট ছোট হাত-পায়ের
ব্যাপার কী? এটা তো ব্ল্যাসফেমি- তুই যেন চাচা-মামার সাথে
কথা বলছিস।
দুধ তো তার জন্য,
যে বর্ধিত হয়। আর জুতো দরকার তার, যার পা আছে।
খোদার জন্য নয়!
তুই যদি এমনকি পয়গম্বরের কথাও বলে থাকিস,
যেমন খোদা বললেন, ‘আমি অসুস্থ ছিলাম, তোমরা আমাকে
দেখতে আসোনি’,
এভাবে বলাটাও বোকামি এবং অসম্মানের।
সঠিক শব্দ ব্যবহার র্ক। ফাতেমা নামটা মেয়েদের জন্য
ঠিক আছে, কিন্তু তুই যদি কোনো
পুরুষমানুষকে ফাতেমা ডাকিস, তা অপমানজনক।
দৈনন্দিনের ভাষা এপাড়ের মানুষের জন্য,
খোদার জন্য নয়।’
মেষপালক অনুতপ্ত হলো। পোশাক ছিঁড়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে
মরুভূমির পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হঠাৎ ওহি নাজেল হলো
মুসা নবীর ওপর, খোদার আওয়াজ :
আমার একজনের কাছ থেকে
তুমি আমাকে বিচ্ছিন্ন করেছো।
তুমি পয়গম্বর হয়ে মিলন ঘটাতে
না ভাঙানি দিতে এসেছো?
আমি প্রত্যেককে আলাদা এবং বিশিষ্টভাবে দেখার,
বুঝতে পারার
আর জ্ঞান প্রকাশ করার ক্ষমতা দিয়েছি।
যা তোমার কাছে ভুল অন্যের কাছে ঠিক, যা তোমার কাছে বিষ
অন্যের কাছে অমৃত
পবিত্র কি অপবিত্র, প্রার্থনায় অলস কি তৎপর
আমার যায় আসে না।
আমি এসবের ঊর্ধ্বে।
এবাদতের তরিকা দিয়ে ভালোমন্দ বিচার করা যায় না।
হিন্দুরা হিন্দুদের মতো করে
ভারতের দ্রাবিড় মুসলমান তাদের মতো করে।
এসবই প্রশংসা, এসবই সঠিক।
এবাদত-বন্দিগির মাধ্যমে আমি মহিমান্বিত হচ্ছি না,
যারা করছে তারাই হচ্ছে। আমি তাদের শব্দগুলি শুনি না
আমি দেখি, অন্তরে তারা কতখানি বিনয়ী।
নীচতাকে ভেঙে বেরিয়ে আসাটাই সত্য,
ভাষা নয়! ভাষার অলঙ্কার ভুলে যাও।
আমি চাই আগুন, আগুন
বন্ধু ভাবো
তোমার জ্বলুনির সাথে বন্ধুত্ব করো।
তোমার ভাবনা ও প্রকাশকে অগ্নিদগ্ধ করো!
মুসা,
যারা কথায় আর আচরণে মনোযোগ দেয় বেশি
তারা এক ধরনের।
আশেক যারা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়
তারা অন্য ধরনের।
পোড়া গ্রামের ওপর করারোপ করো না,
প্রেমিককে বকো না।
তার ‘ভুল’ বলাটা ভালো, অন্যদের একশ গুণ ‘সঠিক’ কথার চেয়ে।
কাবার ভিতর
তোমার জায়নামাজ কোনমুখী তাতে যায় আসে না!
সমুদ্রে যে ঝাঁপায়, স্নো-শু’র তার দরকার নেই
প্রেমধর্মের ধরাবাঁধা নিয়ম বা মতবাদ নেই
শুধু খোদা
চুনিতে তাই নকশা থাকে না!
তাতে দাগের দরকার নেই।
খোদা গভীর তত্ত্বকথা বলতে লাগলেন মুসা নবীকে
দৃষ্টি ও ভাষায় যা রেকর্ড করা যায় না
সেটি তার ওপর বর্ষিত হলো এবং তিনি তা আত্মস্থ করলেন
তিনি নিজেকে ছেড়ে গেলেন তারপর ফিরে আসলেন,
তিনি অমরলোকে গমন করলেন, আবার এইখানে ফিরে এলেন
তা বারংবার ঘটল।
এসব বলার চেষ্টা আমার জন্য বোকামি।
আমি যদি তা বলেও থাকি,
তা আমাদের মানবিক বোধবুদ্ধি শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলবে।
তা আমাদের সব লেখনী চুরমার করে দেবে।
মুসা মেষপালকের পিছনে ছুটলেন
তিনি বিক্ষিপ্ত পায়ের ছাপ অনুসরণ করলেন-
দাবার ঘরের কিস্তির মতো সোজাসুজি এক জায়গায়।
আরেক জায়গয় আড়াআড়ি
বিশপের মতো
এই মুহূর্তে তিনি ঢেউয়ের ফণার মতো উত্তুঙ্গে উঠলেন,
পরের মুহূর্তে নেমে গেলেন মাছের মতো।
তার পায়ের ছাপ সবসময়
বালির বুকে প্রতীক রচনা করে গেল,
রেকর্ড রাখল
তার বিক্ষিপ্ত পদচারণার।
অবশেষে মুসা নাগাল পেলেন
মেষপালকের
‘আমি ভুল ছিলাম। খোদা আমাকে দেখালেন-
এবাদতের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।
তা-ই বলো
তোমার ভালোবাসা যখন যা বলে, তোমার মিষ্টি ব্লাসফেমিই
সঠিক প্রার্থনা। তোমার মাধ্যমে একটি সম্পূর্ণ জগৎ
মুক্তি পায়।
তোমার জবান মুক্ত করে দাও, এ নিয়ে ভেবো না,
এ আত্মারই আলো।’
মেষপালক উত্তর দেয়
‘মুসা, মুসা,
আমি এইসবের বাইরে চলে গেছি।
তুমি চাবুক মারলে আর আমার ঘোড়া চমকে লাফ মেরে
নিজেকে ছেড়ে বেরিয়ে গেল। দৈবপ্রকৃতি আর আমার মানবিক প্রকৃতি
মিলিত হলো।
তোমার তর্জনী আর শক্তিকে সেলাম
আমি বলতে পারছি না যে কী ঘটেছে।
আমি এখন যা বলছি,
তা আমার আসল অবস্থা না, এসব বলা যায় না।’
মেষপালক চুপ করে গেল।
তুমি যখন আয়নার দিকে তাকাও,
নিজেকেই দেখো, আয়নাটা কেমন দেখো না।
বংশীবাদক বাঁশির মধ্যে নিশ্বাস ফেলে
আর কে সঙ্গীত রচনা করে? বাঁশি নয়।
বংশীবাদক!
তুমি যখন খোদাতে প্রশংসা করো
বা ধন্যবাদ জানাও, এটা সবসময়
প্রিয় মেষপালকের সারল্যের মতো।
শেষ পর্যন্ত তুমি যখন
পর্দার মধ্য দিয়ে দেখতে পাও আসল ব্যাপারগুলো কী,
তুমি বারবার বলতে থাকবে,
‘আমরা যা ভেবেছিলাম,
অবশ্যই তা নয়।’
এ কবিতায় রুমী যেমনি ধর্মের পোশাকী আচ্ছাদন খুলে ফেলেছেন তেমনি এসবের ঊর্ধ্বে যে শাশ্বত সত্ত্বা যার কাছে এসবকিছুই মূল্যহীন। যিনি আদি ও অনন্ত, ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের সীমারেখায় যাকে কখনোই বাঁধা যায় না, কোন আনুষ্ঠানিকতা বা ভাষা দিয়ে যাকে স্পর্শ করা যায় না, যে সত্যের উপলব্ধি মানুষকে ঘর-সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এ কবিতা সে সত্যেরই প্রতিধ্বনি তুলেছে।
রুমী আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরোধীতা করেছেন। জাতিভেদ ও ছুতমার্গের বিরোধীতা করেছেন। অসাম্প্রদায়িক ও মানবমহিমা বোধের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কবিতায়। আমাদের বাউল-সাধকদের চিন্তা ও কর্ম এ দর্শনেই বিকশিত হয়েছে- সমৃদ্ধ হয়েছে। তার সাথে আরো যুক্ত হয়েছে বৈষ্ণব চেতনা ও শ্রী চৈতন্যের ভক্তিবিপ্লব। লালন সাঁই বলেছেন, কেউ মালা কেউ তসবীহ্ গলে/ তাতেই কী জাত ভিন্ন বলে?/ যাওয়া কিংবা আসার কালে/ জাতের চিহ্ন রয় কার রে?
ভারতবর্ষে কুলীন হিন্দু ব্রাহ্মণেরা জাতপাতের ধুয়ো তুলে বর্ণপ্রথায় নিম্নবর্গের মানুষদের যখন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, বৌদ্ধরা যখন বুদ্ধের অষ্টমার্গ থেকে বিপথগামী হয়ে মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে অন্যদিকে মুসলমানরা ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে আঁকড়ে ধরে আশরাফ-আতরাফ দ্বন্দ্বে ইসলামের সাম্যকে জলাঞ্জলি দিয়েছে তখনি এখানে সুফীবাদের যেমনি প্রসার ঘটেছে মানুষের অন্তরে তেমনি ঠাঁই করে নিয়েছে বাউলদের মানবতাবাদী মানুষতত্ত্ব। জালালুদ্দিন রুমীর মরমী দর্শন বাউলদের মানুষতত্ত্ব ও এই বাংলার এই ভাবসাধনাকে বুঝতে সাহায্য করবে।
শেখ সাদী বলেছেন-
শুরু করি তাঁর নামে, যাঁর কোন নামই নেই
অথচ যে নামেই তাকে ডাকা যায়
তাতেই তিনি মাথা তোলেন।
অতি সহজে মনোমোহন দত্ত একথা বলেছেন-
নাহি তাতে ভেদাভেদ অহিংসা অভেদ
কোরান-পুরাণ-আদি বাইবেল কি বেদ,
সবে ফুঁকারিয়া কয়, ভাব অবিচ্ছেদ
অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডময় রবে না বিচ্ছেদ।
প্রেমের সোপানে কোনও জাত-পাত বা ধর্মভেদের জায়গা নেই। কোন শব্দ বা বাক্য দিয়ে তাকে স্পর্শ করা যায় না। দিওয়ান-ই-শামস গ্রন্থে রুমী বলেছেন-
প্রণয়পাত্রের পথে অন্তর আমাদের হারিয়ে গেছে;
বিশ্বে মতানৈক্যের সৃষ্টি করেছি আমরা।
মানুষের অন্তরে আমরা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছি,
আর প্রেমিকদের নিক্ষেপ করেছি অধৈর্যের মধ্যে।
সকল বিষয়-সম্পদ আমি পরিহার করেছি;
বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি।
আমার পিঠে একটা ভারী বোঝা ছিল,
আল্লাহ্কে ধন্যবাদ, সে বোঝা আমি ছুঁড়ে ফেলেছি।
প্রেমে সারাক্ষণ আত্মসমর্পিতা রাবেয়া বসরী আত্মবিভোরে প্রায়ই উচ্চারণ করেছেন, ‘হে আমার প্রভু, এই দুনিয়ার যতটুকু অংশ আমায় দিতে চাও তোমার শত্রুদেরই তা দান করো এবং পারলৌকিক জগতের যতটুকু অংশ তুমি আমাকে দান করবে, তা তোমার বন্ধুদের দিয়ে দাও। আমার জন্য তুমিই তো যথেষ্ট।’
রুমী বলেছেন-
গভীর গহন থেকে উঠে এলাম আমি ঊর্ধ্বলোকে
আমার সে মনোহর প্রেমাস্পদের সন্ধানে
আত্মার জগতে সে একজনের সাথে আমার ভালোবাসা ছিল;
এ জন্যেই আমি ফিরে গেলাম সেখানে, যেখান থেকে আমি এসেছিলাম।
এই গভীর গহন থেকে উত্থিত হয়েই মানুষ ফেলে আসা সে মানুষকে খুঁজে বেড়ায়, আমি ফেলে আসা সেই আমিকে খোঁজে। জীবনব্যাপী খ্যাপার মতন এই খুঁজে ফেরা। আর যখন খুঁজে পান তখন যেমনি আত্মহারা হন, তেমনি অদৃশ্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আবার দৃশ্য অদৃশ্যে মিলায়। তখন সকল ব্রহ্মাণ্ড হয়ে ওঠে আমিময়। আর তখনি প্রেমিক, প্রণয়ের পাত্র ও প্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কোন কিছুরই তখন আলাদা কোনও অস্তিত্ব থাকে না। আর তাই রুমীর আহ্বান গভীর গহন থেকে উঠে আসা সূর্যকিরণের মতো প্রজ্জ্বলিত, শাশ্বত।
সূত্র :
* ১, ২ চৌধুরী শামসুর রহমান অনূদিত।
* মসনবীয়ে রুমী, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী (র), প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় খণ্ড, চতুর্থ খণ্ড, অনুবাদ - মাওলানা আব্দুল মজিদ, এমদাদীয়া লাইব্রেরী, ঢাকা, ১৯৯৫
* সোল অব রুমী, কোলম্যান বার্কস, অনুবাদ : আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০০৬
* কিতাব আল-তাওয়াসিন, মনসুর আল-হাল্লাজ, ভাষান্তর ও সম্পাদনা - রায়হান রাইন, সংবেদ, ঢাকা, ২০১০
* সূফী দর্শন, চৌধুরী শামসুর রহমান, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০২
* মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ও বিশ্বখ্যাত শত মুসলিম মনীষী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ঐহিত্য, ঢাকা, ২০০২
* মালাকাত-ই শামস-ই-তাবরেজি, অনুবাদ : সাব্বির হাসান নাসির, র্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০০৯
* বিশ^প্রেমিক রুমী, শামসুদ্দিন মুহম্মদ ইসহাক, ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, চট্টগ্রাম, ১৯৭৪
* Selected Poems, Maulana Jalaluddin Rumi, Translated : Coleman Bank, PENGUIN BOOKS, London, 1995
* ইন্টারনেট