না’গঞ্জ-মুন্সীগঞ্জের আলু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ক্রেতার পকেট কাটছে
ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশ: ০০:১৪, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪
মূলত: দু’টি অজুহাতে আলুর দাম বাড়ানো হচ্ছে। আলুর জন্মজেলা মুন্সীগঞ্জে পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫/৪৬ টাকা দরে। খুচরা বাজারে একলাফে বেড়ে যাচ্ছে ১৪ টাকা। ৪৬ টাকা কেজির আলু হয়ে যাচ্ছে ৬০ টাকা। পাশর্^বর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা আরো ১০ টাকা বাড়িয়ে ৭০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছে। নারায়ণগঞ্জবাসীর পকেট কাটছে আলু ব্যবসায়ীরা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ বিষয়ে নজর দিচ্ছে না। ফলে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলার আলু ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে জনগনের পকেট কাটছে।
সূত্রমতে, এ বছর আলুর বাজারদর বেশি হওয়ায় আলু পরিপক্ক হওয়ার আগেই অনেক চাষী খেত থেকে আলু তুলে বাজারে বিক্রি করেছেন। এতে উৎপাদন কমে গেছে। আলু উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ জেলা নারায়ণগঞ্জের পাশর্^বর্তী মুন্সিগঞ্জ। এখানেও এবার আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ৪ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৩৬ হাজার ২৫০ টন। যদিও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৩ টন। এছাড়া জেলায় এবার আলুর উৎপাদনশীলতাও কমেছে।
টঙ্গীবাড়িতে মজুত করা হিমাগারের আলু খুচরা পর্যায়ে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছেন। উপজেলার হিমাগারগুলোতে প্রতি ৫০ কেজি বস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৩০০ টাকা দরে, যার প্রতি কেজি মূল্য ৪৬ টাকা। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি আলু ৬০ টাকা। আলুর দাম চড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতীয় আলু আমদানি বন্ধ ও দেশীয় আলুর সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে।
কাঁচামালের আড়ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় দাম কিছুটা বাড়তি। হিমাগার থেকে খচুরা বাজারে প্রতি কেজি আলু ১৪ টাকা বেশি দরে বিক্রি হওয়ায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একটি মহল পাইকারি আলু হিমাগার থেকে কিনে খুচরা বাজারে বেশি মুনাফা করার জন্যই বাড়তি দামে আলু বিক্রি করছে।
জানা যায়, টঙ্গিবাড়ি উপজেলায় ৯ হাজার ১৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ করা হয়েছিল। ২৭ হিমাগারের মধ্যে চালু রয়েছে ২৪টি হিমাগার। এ সকল হিমাগারে কৃষকের বীজ আলু রয়েছে ২৭ হাজার ৬৫২ মেট্রিক টন, খাবার আলু মজুদ রয়েছে ৩৬ হাজার ১০৮ মেট্রিক টন।
একজন কোল্ড স্টোর ম্যানেজার মো. আহসান-উল রাব্বি জানান, এই হিমাগারের আলু মজুত রাখার ধারণক্ষমতা রয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার। প্রতি ৫০ কেজির জন্য ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫০ টাকা। একজন কৃষক হিমাগারে ৯ মাসের জন্য তার আলু মজুত রাখতে পারে। তার এই হিমাগারে কৃষকের বীজ আলু মজুত রয়েছে ৩০ হাজার বস্তা এবং খাবার আলু মজুত রয়েছে ২৮ হাজার বস্তা।
মুন্সীগঞ্জে বিদেশি বীজ আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে কৃষকদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। আমদানি করা আলুর বীজ তাদের কাছে যেন সোনার হরিণ। জানা যায়, ৫০ কেজি ওজনের আমদানি করা আলুবীজ বিক্রি হচ্ছে ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকায়, যা এক মাস আগেও বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকায়।
এ ছাড়া হিমাগারে সংরক্ষিত কৃষকের পুরোনো ৫০ কেজি ওজনের বীজ আলুর বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। এ বছর আলুর বাজার দর সবসময় বেশি থাকায় বেশি লাভের আশায় আলু চাষের দিকে ঝুঁকছেন মুন্সীগঞ্জের কৃষক। সরকারিভাবেও বাড়ছে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু বীজ সংকটের শঙ্কায় আলু চাষ ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। আলু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অরিত্র এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী রনি শেখ বলেন, তারা আলু আমদানির যখন এলসি করেন, তখন অল্প লাভে ডিলারদের কাছে বীজ আলু বিক্রি করে দেন। ডিলাররাই কারসাজি করে দাম বাড়ান।
রনি আরও বলেন, এ বছর হল্যান্ডে আলু রোপণ মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ায় আলু উৎপাদন বিলম্ব হয়। এ কারণে বীজ সময়মতো তারা সরবরাহ করতে পারেনি। তাই এ বছর এলসি কম হয়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েল, ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কারণে আলুভর্তি জাহাজগুলো দীর্ঘপথ ঘুরে বাংলাদেশে আসছে। এতে জাহাজ ভাড়া প্রায় ৩ গুণ বেশি পড়ছে এবং সময়ও লাগছে বেশি।
মুন্সীগঞ্জ সদরের ডিলার আব্দুল গফুর জানান, আলু বহনকারী কাঠের বাক্সগুলো ইউক্রেন ও রাশিয়ার উৎপাদিত পাইন গাছের কাঠ থেকে তৈরি করা হয়। যুদ্ধের কারণে এখন অন্য জায়গা থেকে কয়েক গুণ বেশি মূল্যে গাছ কিনছেন হল্যান্ডের বীজ রপ্তানিকারকরা। কৃষক যদি কাঠের বাক্সের মাধ্যমে আলু না নিয়ে বস্তায় নিতেন, তাহলে ৫০ কেজি আলু আরও এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা কম মূল্যে বিক্রি করা যেত। কিন্তু বস্তায় ভরে আলু বিক্রি করলে সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা বীজ, তা কৃষকরা বিশ্বাস করেন না। তাই বাধ্য হয়ে বাক্সে আলু বিক্রি করতে গিয়ে দাম পড়ছে বেশি।
কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন, এ বছর জমির জমা দাম অনেক বেশি ছিল। ১ শতাংশ জমি ১ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা দিয়ে ইজারা নিয়েছেন। কিন্তু এখন যদি বীজ না পাওয়া যায়, তাহলে সবই শেষ। গত বছর হল্যান্ড থেকে আমদানি করা বীজ থেকে যারা বীজ আলু উৎপাদন করে হিমাগারে সংরক্ষণ করেছেন, তারা ৫০ কেজি বস্তা বীজ ৪ হাজার টাকা চাচ্ছেন, যা দুই বছর আগে ৮০০-১০০০ টাকায় বিক্রি হতো।
দেশে এবার আলুর উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে ব্যাপক হারে কৃষকরা অপরিণত আলু তুলেছেন। কারণ বাজারে দাম বেশি ছিল। এটি সার্বিক উৎপাদন কমানোয় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে আলুতে রোগবালাইও ছড়িয়েছে বেশি। এতে দামের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হতে পারে। তবে আলুর সংকট তীব্র হওয়ার শঙ্কা কম। কারণ মানুষ আলু খাওয়া কমিয়েছে। দাম বেশি হওয়ার কারণে আগে যিনি ১০ কেজি আলু কিনতেন, তিনি এখন পাঁচ কেজি কিনছেন। সব মিলিয়ে সংকট তীব্রতা না পেলেও বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার একটা শঙ্কা থেকে যাবে।’
দেশে বর্তমানে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭৫-৮০ লাখ টন। এর মধ্যে আলুর সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতি হয় প্রায় ১০-১৫ শতাংশ। সে হিসাবে বছরে আলু উৎপাদনের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯০-৯৫ লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৬ টন। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে শুরুতে তা ছিল ১ কোটি ১২ লাখ টন। এরপর বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় সরকারি হিসাবের চেয়ে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ আলু উৎপাদন কম হয়েছে। এ কারণে গত বছরের শেষদিকে বাজারে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। এখনো তার রেশ কাটেনি।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘আগে প্রতি একর জমিতে ১১ টন আলু পাওয়া যেত। কিন্তু এবার কৃষক পর্যায়ে আমরা যেটা শুনেছি, প্রতি একরে তারা আট-নয় টন আলু পেয়েছেন। আবার গত বছর আলুর উৎপাদন কম হওয়ায় অনেকে বীজ আলু বিক্রি করে দিয়েছিল। এ কারণে এ বছর আলুর আবাদি জমি কিছুটা কমে গিয়েছিল। তবে উৎপাদন যা হয়েছে, বলা যায় গত বছরের মতোই। গত বছর মাঠ পর্যায়ে আলুর দাম ছিল ১২-১৩ টাকা। কিন্তু এবার সেটা ছিল ২৮-৩২ টাকা। ফলে খুচরা বাজারে এর প্রভাব সারা বছরই থাকবে। প্রত্যেকেই অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। গত বছর আলুর উৎপাদন সরকারি তথ্যের চেয়ে অনেক কম হয়েছিল। এবারো তার কাছাকাছি উৎপাদন হবে।’